রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৪

বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারা


বাংলাদেশের সাহিত্যে ছোটগল্পের বিশিষ্ট স্থান সুনির্দিষ্ট হয়েছে সামাজিক-মানবিক ও আর্থ-রাজনৈতিক আবহ ধারণ করে। ছোটগল্পের ভুবনে সঞ্চিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর মানব জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। খ্যাতিমান অনেক গল্পকার-উপন্যাসিককে আমরা পেয়েছি। তাদের ফলবান সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশের গল্পলোক। রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় মানুষের আকাক্সক্ষা-সংগ্রাম, দোদুল্যমানতা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে গল্পে তেমনি মানুষের সম্ভাবনা, সমাজবাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রবণতা ফুটে উঠেছে শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতায়। কবিদের মতো গল্পকারদের দশকওয়ারি বিভাজন রয়েছে। দশকের সংকীর্ণতা পেরিয়ে যারা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গল্পকার হিসেবে নিজেদের উচ্চ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তারা হলেনÑরশীদ করিম, সোমনে চন্দ, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবু রুশ্দ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সিকান্দার আবু জাফর, আশরাফ সিদ্দিকী, মিন্নাত আলী, শওকত ওসমান, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ইসহাক চাখারী, বশীর আলহেলাল, রিজিয়া রহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, কায়েস আহমেদ, সেলিনা হোসেন, শহীদ সাবের, মঞ্জু সরকার, হরিপদ দত্ত, মঈনুল আহসান সাবের, মনিরা কায়েস, শহিদুল জহীর, নাসরীন জাহান, মাহমুদুল হক, সুচরিত চৌধুরী, রাহাত খান, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, রশীদ হায়দার, আল মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মশিউল আলম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এ ছাড়া লিখে চলেছেন কাজল শাহনেওয়াজ, বিপ্রদাশ বড়–য়া, হুমায়ূন মালিক, মহীবুল আজিজ, ইমতিয়ার শামীম, সুশান্ত মজুমদার, সালাম সালেহ উদদীন, চঞ্চল আশরাফ, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, জাকির তালুকদার, অদিতি ফাল্গুনী, শাহনাজ মুন্নী, আকমল হোসেন নিপু, আবু হেনা মোস্তফা এনাম, মনি হায়দার, সরকার আশরাফ, পাপড়ি রহমানসহ অনেকে।
বাংলাদেশের ছোটগল্পে রূপায়িত হয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধতা, পশ্চাৎবর্তিতা, ধর্মান্ধতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকট, নিম্নবর্গের অনুভূতি, জীবন জটিলতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তির আকাক্সক্ষা, শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু এর ঐতিহাসিক পটভূমি এবং রাজনৈতিক-সামাজিক ধারাবাহিকতার অন্বেষণ করতে হয় ৫২-র ভাষা আন্দোলনে, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, ৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকা- ও ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে। এসব ঘটনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় গল্পকাররা প্রভাবিত হয়েছেন। গল্পকারদের মানসপ্রভাব ও প্রবণতার ছাপ পড়েছে তাদের গল্পে। বাংলাদেশের মানুষ আবহমান বাংলার সৌন্দর্যময় প্রকৃতির চেতনা ধারণ করে বড় হয়েছে। এখানকার নদী, জল, পাহাড়, জলাশয়, বিল, হাওর সজীবরূপে প্রভাবিত করেছে মানুষের চেতনালোকে। সামাজিক সম্পর্কের ঘটনাক্রম, সামাজিক রীতি-প্রথা আর মূল্যবোধের প্রভাবে ক্রমবর্ধিত হয়েছে মানুষের বাঙালিসত্তা। বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতাপরবর্তী কালের অবস্থা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনপ্রবাহের অব্যাহত প্রভাবেও গড়ে উঠেছে মানুষের মনোচৈতন্য ও সমাজবাস্তবতা।
১৯৪৭ সালের পরবর্তী পুরো পাকিস্তান আমলে বাঙালির মধ্যে রয়েছে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রবল দ্রোহচেতনার পরিচয়। ৪৮ থেকে ৫২ সালের পটভূমিতে গড়ে ওঠা চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে গল্পে। ধর্মভিত্তিক দ্বিখ-িত রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতার কবলে পড়েছে বারবার। সেগুলো গল্পে এসেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ধর্মান্ধতার প্রবণতায় মানুষের শান্তি বিনষ্ট হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি দুঃশাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। সমকালীন গল্প-উপন্যাসে তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ প্রভাবিত স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা সৃষ্টি হয়েছে এ দেশে।
সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার লড়াইয়ের অস্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রেরণাবাহী। মানুষ জাগ্রত হয়েছে সাহিত্যের প্রভাবে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মধ্যবিত্তের সুযোগসন্ধানী প্রবণতা, সংগ্রামমুখরতা রূপায়িত হয়েছে। সাত ও আট দশকের গল্পে এসেছে সমকালীন রাজনীতির প্রভাব। ১৭৫৬, ১৮৫৭ ও ১৯০৫ সালের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম ও পরিবর্তনের প্রবাহ আমাদের সাহিত্যে এসেছে ইতিহাসের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন, ভারতের থেকে বাংলা ভাগ হওয়া, বঙ্গভঙ্গের দুঃখজনক অধ্যায় আর পাকিস্তানের দ্বিখ-িত হওয়ার ঘটনাগুলো এবং রাজনৈতিক পটভূমির কথকতা দুই বাংলার উপন্যাসে যতটা এসেছে গল্পে তেমন আসেনি। বাংলাদেশের গল্প বিভাজনের ক্ষেত্রে ত্রিশের দশক, চল্লিশের দশক, পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক, সত্তরের দশক, আশির দশক, নব্বইয়ের দশক-এভাবেই সুবিন্যস্ত করার একটি প্রবণতা লক্ষণীয় বিষয়। ত্রিশের দশকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দিন, সোমেন চন্দ, আবু রুশদ, সরদার জয়েনউদ্দিন, শওকত ওসমান-এর মতো শক্তিশালী গল্পকারের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। তারা পরবর্তী পর্যায়েও অনেকেই আরো বহুমাত্রিকভাবে গল্পভুবনকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করেছেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের ভয়ংকর ঘটনা, অমানবিক তৎপরতা চালিয়েছে অপশক্তি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তৎপরতা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পরিকল্পনা রুখে দিয়েছিল বাঙালিরা। বিদ্রোহী বাঙালি মুসলমানরা মুক্তির পথ খুঁজেছে স্বদেশ চেতনায়, মাতৃভাষাপ্রেমে। ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল তাদের রাজনীতি। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনবিরোধী চেতনায়, বলীয়ান হয়েছে জনগণ। মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত 'মোহাম্মদী' (১৯৪৬) পত্রিকায় রশীদ করীম-এর গল্প 'ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই' প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩ সালে 'দাঙ্গা' শীর্ষক গল্প প্রকাশ করেন সোমেন চন্দ (প্রতিরোধ, ঢাকা)। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নলিনী রায় সম্পাদিত মুক্তধারা (কলকাতা, ১৩৩৮) পত্রিকায় সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প 'দাঙ্গা' প্রকাশিত হয়। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক ঘটনার কুপ্রভাব, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবাদর্শ ও সামাজিক প্রগতির চেতনা সক্রিয় ছিল এ সময়কার গল্পকারদের মধ্যে। সওগাত পত্রিকায় (১৩৫৬, ৩৩ বর্ষ, ১ম সংখ্যা) সিকান্দার আবুজাফরের 'ঘর' শীর্ষক গল্প প্রকাশিত হয়। বিভাগপূর্ব (সাতচল্লিশপূর্ব) কালে রশীদ করীম, সোমেন চন্দ আর সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প উল্লেখযোগ্য। পূর্ববঙ্গের (১৯৪৭-১৯৫০) সাহিত্যধারায় আমরা অনেক গল্পের সন্ধান পাই যাতে রয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনার প্রতিফলন। মোহাম্মদী পত্রিকায় (ঢাকা, আশ্বিন, ১৩৫৪) মুহাম্মদ আবদুল হাই লিখেছেন 'বেসুর' শীর্ষক গল্প। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর 'স্বাক্ষর' গল্পটি সওগাত পত্রিকার (ঢাকা, মাঘ, ১৩৫৪) প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকায় 'পুনর্বাসন' শীর্ষক গল্প প্রকাশিত হয়েছে আবু জাহাঙ্গীরের।
আবদুল কাদির সম্পাদিত দিলরুবা (ঢাকা, শ্রাবণ, ১৩৫৬) পত্রিকায় 'হাড়' নাম এবং আবদুর রশীদ সম্পাদিত মাহে নও (আগস্ট, ১৯৫০) পত্রিকার মোহাজের শীর্ষক গল্প প্রকাশিত হয়। আলাউদ্দিন আল আজাদের ছুরি (দাঙ্গার পাঁচটি গল্প, ঢাকা, ১৩৫৬), শিকড় (জেগে আছি, ঢাকা, ১৯৫০), রোগমুক্তির ইতিবৃত্ত (ঐ, ১৯৫১), মেঘনা (অগত্যা, ঢাকা, ১৩৫৭) শীর্ষক চারটি গল্প সাড়া জাগিয়েছিল পাঠকমহলে। আশরাফ-উজ-জামানের রিকশাওয়ালা (মাহে নও, ঢাকা, ১৯৫০), বিস্তৃতি (মোহাম্মদী, ঢাকা, ১৩৫৭) গল্প দুটি প্রকাশিত হয়েছিল। মাহে নও পত্রিকায় ওবায়েদ-উল-হকের তিনটি গল্প তসলীমা, বাপ-বেটি ও মন্তুর বৌ প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের অতন্দ্র শীর্ষক গল্প প্রকাশিত হয়েছিল দাঙ্গার পাঁচটি গল্প শীর্ষক পত্রিকায়। মাহে নও (১৯৫০) পত্রিকায় মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর মোহাজের গল্পটি ছাপা হয়। সিকান্দার আবু জাফরের ঘর শীর্ষক গল্পটি সওগাতে (১৩৫৬) ছাপা হয়। পূর্ববঙ্গের (১৯৫১-১৯৬০) সাহিত্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও আলাউদ্দিন আল আজাদ ছাড়াও পাই আকবর উদ্দীনের গল্প পারাপার (মোহাম্মদী, ঢাকা, ১৩৬১), আতোয়ার রহমানের বুদ্বুদ (দিলরুবা, ঢাকা, ১৩৫৮) ও এক মাসের ব্যবসা (মোহাম্মদী, ঢাকা, ১৩৫৮) শীর্ষক গল্পদ্বয়। আবু শামসুদ্দিন ইতিহাস নামক গল্পটি লিখেছেন মুখর প্রান্তর (যশোর, ১৩৬৭) পত্রিকায়। আশরাফ সিদ্দিকীর পুকুরওয়ালা বাড়ী (মোহাম্মদী, ঢাকা, ১৩৫৯), ইব্রাহিম খাঁর দুইটি মানুষ (শতদল, ঢাকা, ১৯৫৯), মিন্নাত আলীর একটি পলিটিক্যাল স্বপ্ন (আমার প্রথম প্রেম, ঢাকা, ১৯৫৯), সবার উপরে মানুষ সত্য (মাহে নও, ঢাকা, ১৩৫৮), হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে (মফস্বল সংবাদ, ঢাকা, ১৯৫৮) শীর্ষক গল্প। মোসলেম উদ্দীন আহম্মেদের দুর্গত শিবিরের বাইরে (দিলরুবা, ঢাকা, ১৩৫৮), মোহাম্মদ আমিনুল হকের মৃত্যু (মাহে নও, ঢাকা, ১৯৫১), শামসুদ্দিন হায়দারের যাযাবর (মাহে নও, ঢাকা, ১৯৫৫), সরদার জয়েনউদ্দিনের ইতিহাসের ছেঁড়াপাতা (খরস্রোত, ঢাকা ১৩৬২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ববঙ্গ (১৯৬১-১৯৭০) সাহিত্যধারায় আরো যে সব গল্পকার ও গল্প চিহ্নিত করা যায় তারা হলেন আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের সকলের জন্য (মোহাম্মদী, ঐ, ১৩৭১), আজহারুল ইসলামের ঋণের বোঝা, প-িত মশাই (ভগ্নাংশ, ঢাকা, ১৯৬৭), আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প-১৯৬৪, (১৯৭০), আবু ইসহাকের বনমানুষ (হারেম, ঢাকা, ১৩৬৯) প্রভৃতি। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য আরো গল্প লিখেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। সেগুলো হলো উজান তরঙ্গে (মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৬২), দুপুরে প্রস্থান, (যখন সৈকত, চট্টগ্রাম, ১৯৬৭)। ইসহাক চাখারীর গল্প রায়ট (জানালা, ঢাকা, ১৯৬৭), বশীর আল হেলালের ছুটন্ত জঙ্গলে (স্বপ্নের কুশীলব, কলকাতা, ১৯৬৭), মোনাজাত উদ্দিনের আবার নতুন করে (মোহাম্মদী, ১৩৭১), রিজিয়া রহমানের এক কান্নার স্বাদ (অগ্নিস্বাক্ষর, ঢাকা, ১৩৭৪) প্রভৃতি উল্লেখ্য। শওকত ওসমানের গল্প আখেরী সংক্রান্ত (সমকাল, ঢাকা, ১৩৭২)। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প (আখতার হুসেন সম্পাদিত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯১১) গ্রন্থে শওকত ওসমান লিখেছেন মন্ত্রগুণ গল্পটি। হাসান হাফিজুর রহমানের মানিকজোড় (সমকাল, ঢাকা, ১৩৭০), মাছ, আরো দুটি মৃত্যু (মাছ, আরো দুটি মৃত্যু, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৭০) গল্পদ্বয় প্রকাশিত হয়েছিল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি তুলসী গাছের কাহিনী (দুই তীর ও অন্যান্য গল্প, ১৯৬৫) শীর্ষক গল্পটিও উল্লেখযোগ্য। হাসান আজিজুল হকের গল্প উত্তর বসন্তে (সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য, পাকিস্তান লেখক সংঘ, ঢাকা, ১৩৭১), পরবাসী (আত্মজা ও একটি করবী গাছ, ঢাকা, মুক্তধারা, ১৯৬৭), মারী (সমকাল, ঢাকা, ১৩৭৩) ও খাঁচা (নির্বাচিত গল্প, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯১৬) প্রভৃতিতে রয়েছে সমাজচিন্তার প্রতিফলন। '৪৭-এর দেশবিভাগের গল্পে মধ্যবিত্তের জীবনকথা আছে, দেশভাগের দুঃখকথা আছে, প্রগতিচেতনায় জাগ্রত হওয়ার কামনা আছে, নিপীড়িত নিম্নবর্গীয় দ্রোহচেতনার প্রকাশ আছে, ভাষা ও সংস্কৃতির সত্তায় হামলাকারীদের প্রতিরোধের প্রবণতা আছে। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের গল্পভুবনেও পাওয়া যায় আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র, মূল্যবোধের স্বাক্ষর আর পরাধীন অর্থনীতি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের তৎপরতার প্রতিচ্ছবি। এ সময়ের গল্পকাররা সমাজবাস্তবতা বিষয়ে সচেতন হয়ে লিখেছেন, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব আলোকে শিল্পসুষমার পরিচয় দিয়েছে গল্প রচনায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা, রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা, প্রগতিশীল গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার গণআকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় কিছু গল্পে। চল্লিশের দশকের গল্পভিত্তি নির্মিত হয়েছিল শামসুদ্দিন আবুল কালামের শাহের বানু, আবুল ফজলের পৃথিবী, আবুল মনসুর আহমদের আয়না, মাহবুব-উল আলমের মফিজন, শাহের আলীর জিবরাইলের ডানা আর আবু ইসহাকের মহাপতঙ্গ-এর মাধ্যমে। তাদের গল্পে রূপায়িত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, আর্থিক মন্দা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিজ্ঞতা, উদ্বাস্তু সমস্যা, দুর্নীতি ও বৈষম্যের ঘনঘটা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, গ্রাম ও শহরের ব্যবধান, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বৈরথ, ব্যক্তির মনোদ্বন্দ্ব সামাজিক অধিকার, নিপীড়ন-নির্যাতন, মানবীয় হীনম্মন্যতা প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকের গল্পকার ও উপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, শওকত আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু রুশ্দ, রশীদ করীমের গল্পভাষ্যে। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা যাদের গল্পে অধিক স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তারা হলেন আবুল মনসুর আহমদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবু ইসহাক, শাহেদ আলী, হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, শহীদুল জহির, রাহাত খান, হরিপদ দত্ত, মশিউল আলম ও সালাম সালেহ উদদীনের গল্পে। মধ্যবিত্তের দুঃখকষ্ট, জীবন জটিলতা, আকাক্সক্ষা ও দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে যাদের গল্পে তারা হলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু রুশ্দ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন ও আনিস চৌধুরী।
বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ও প্রভাব লক্ষণীয় বিষয়। বাংলাদেশ নামক সার্বভৌম রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আছে বাংলাদেশের জন্মবেদনা থেকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস। এরই ধারাবাহিকতা ধারণ করে গল্পকাররা অগ্রসর হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প লিখেছেন বশীর আলহেলাল (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২), হাসান আজিজুল হক (নামহীন গোত্রহীন, ১৯৭৫) সৈয়দ শামসুল হক (জলেশ্বরীর গল্পগুলো, ১৯৯০), শওকত ওসমান (জন্ম যদি তব বঙ্গে, ১৯৭৫), আলাউদ্দিন আল আজাদ (আমার রক্ত, স্বপ্ন খামার, ১৯৭৫), আবু জাফর শামসুদ্দীন (রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, ১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিক (মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ১৯৭৭)। এ ছাড়া আমজাদ হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও সেলিনা হোসেনের গল্পে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। রশীদ হায়দার, হুমায়ুন আজাদ, রাহাত খান, সত্যেন সেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, মঈনুল আহসান সাবের ও বিপ্রদাশ বড়–য়ার গল্পে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন। মৌলিক গল্পকারগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ ও বরণ করেই লিখেছেন গল্প। সত্তরের দশকে নতুন রাষ্ট্র পেয়ে জনগণের মনে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের জয়ধ্বনি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতি আশাবাদ জেগেছিল মানুষের মনে। সেই আকাক্সক্ষা গল্পকারদের চেতনায়ও সক্রিয় ছিল।
ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক কবর নাটকের মাধ্যমে খ্যাতিমান মুনীর চৌধুরীও রাজনৈতিক ধারার গল্প লিখেছিলেন। নগ্ন পা ও খড়ম গল্প দুটো রাজনৈতিক চেতনাবাহী। রাবেয়া খাতুনের টেনশনে ভুগছে গোটা দেশ শীর্ষক গল্পটি রাজনৈতিক চেতানাঋদ্ধ। পাঁচ-এর দশকে সত্যেন সেন, হাসান হাফিজুর রহমান আর সিকান্দার আবু জাফর কিছু ব্যতিক্রমী সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ গল্প লিখেছিলেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক উত্তাল অবস্থা গল্পকারদের চেতনাকে দোলা দিয়েছিল। ছোটগল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও ভূ-রাজনৈতিক বদলের প্রেক্ষাপট তাদের বিবেচনায় ছিল। ফলে তাদের রচিত গল্পে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবাহ অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিন উত্তরণ (এনামুল হক সম্পাদিত), সাম্প্রতিক (শাহজাহান হাফিজ সম্পাদিত), প্রতিধ্বনি (ফারুক আলমগীর সম্পাদিত), কণ্ঠস্বর (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত), সুন্দরম (ফেরদৌস সাজেদীন সম্পাদিত), শ্রাবন্তী (শশাঙ্ক পাল সম্পাদিত) প্রভৃতি। এসব লিটল ম্যাগাজিনে বহু নিরীক্ষাধর্মী গল্প ছাপা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানেও অনেক সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছিল যাতে রাজনৈতিক চেতনাবাহী গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। আইয়ুবী স্বৈরশাসনের দ্রোহচেতনা এসব গল্পে সতেজ ছিল। ষাটের দশকের বহু গল্পকারের মধ্যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের নাম অধিক উচ্চারিত হয়েছিল। তার গল্পে সমাজবাস্তবতা প্রতিফলনের কারণে। ছয় দশকের গল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রাহাত খান, মাহমুদুল হক, রশীদ হায়দার, আহমদ ছফা, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, কায়েস আহমদ, আনোয়ারা সৈয়দ হক, বশীর আলহেলাল, জুবাইদা গুলশান আরা, আমজাদ হোসেন, আন্ওয়ার আহমদ, দিলারা হাশেম, ঝর্নাদাশ পুরকায়স্থ, সালেহা চৌধুরী তাদের সাহিত্যিক অবস্থানকে জোরদার করেছেন সামাজিক-রাজনৈতিক গল্প রচনার মাধ্যমে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক অতুলনীয় হয়ে আছেন ছয় দশকের শীর্ষস্থানীয় গল্পকার হিসেবে। এ ছাড়া সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক আর পুরবী বসুও উল্লেখযোগ্য।
সাত-এর দশকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার পটভূমি আর স্বকীয় রাজনীতির আবহে রচিত হয়েছে গল্প। মঈনুল আহসান সাবের, হরিপদ দত্ত, সুশান্ত মজুমদার, মঞ্জু সরকার, হুমায়ূন আহমেদ, বুলবুল চৌধুরী, আতা সরকার, শাহরিয়ার কবির, ইমদাদুল হক মিলন, মনিরা কায়েস-এর নাম সাত দশকে উল্লেখযোগ্য। হরিপদ দত্ত, মনিরা কায়েস, মঈনুল আহসান সাবের, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের নাম বাংলাদেশের গল্পভুবনে দীর্ঘস্থায়ী মাত্রা লাভ করেছে। হরিপদ দত্তের পিতৃভূমি এবং কুকুর ও আকাশের চাঁদ উল্লেখযোগ্য গল্প। শহুরে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত আর গ্রামীণ নিম্নবর্গ নিয়েও লেখা হয়েছিল গল্প। এ ক্ষেত্রে মঈনুল আহসান সাবেরের নাম উল্লেখযোগ্য। আট-এর দশকজুড়ে গল্পের প্রকাশ সম্ভাবনা বেড়েছে। পত্রপত্রিকার সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষত ঈদসংখ্যা, সাহিত্য সাময়িকীসহ লিটল ম্যাগাজিনকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছিল অনেক গল্প। সাত-এর দশকের নাসরীন জাহান, শহীদুল জহির, ইমতিয়ার শামীম, হুমায়ূন মালিক, শহীদ খান, ঝর্না রহমান, মাখরাজ খান, সাদ কামালীসহ অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য। নয়-এর দশকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙন, সমাজতন্ত্রের ধস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা। জাতীয় পরিসরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সেনাশাসনের পতন, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা, গণআন্দোলনে বিজয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এসব ঘটনার প্রভাবে গল্পকারদের চেতনা সমৃদ্ধ হয়েছে। সাত-এর দশকে গল্প লিখেছেন অনেকেই। উল্লেখযোগ্যরা হলেন মশিউল আলম, আহমাদ মোস্তফা কামাল, সালাম সালেহ উদদীন, আকিমুন রহমান, অদিতি ফাল্পুনী, আকমল হোসেন নিপু, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, চঞ্চল আশরাফ, পাপড়ি রহমান, প্রশান্ত মৃধা, মনি হায়দার, মাসুদুল হক, রায়হান রাইন, শাহনাজ মুন্নী, দীলতাজ রহমান, সমীর আহমেদ, রাশেদ রহমানসহ অনেকেই। নয় দশকের তালিকাও ভরপুর হয়ে উঠেছে অনেক গল্পকারের পদচারণায়। চন্দন চৌধুরী, রাহাদ আবির, অরণ্য প্রভা, ফজলুল কবিরী, তুহিন সমদ্দার, সৈকত আরেফিন, শাজান শীলন, বাকী বিল্লাহ, বদরুন নাহার, প্রবীর পাল, নূরুননবী শান্ত, মাজুল হাসান, জামাল উদ্দীন, জাহেদ সারোয়ারসহ অনেকেই ভালো গল্প লেখার চেষ্টা করছেন। দেশব্যাপী লিটল ম্যাগাজিনগুলোর আশ্রয়ে ছাপা হচ্ছে প্রচুর গল্প। তাদের সবার নাম এখানে তুলে ধরা গেল না উপযুক্ত তথ্যপ্রাপ্তির অভাবে। নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে ছোটগল্প হতে পারে একটি সাহিত্যাস্ত্র। সে জন্য গল্পকারদের হতে হবে তীক্ষè রাজনীতিসচেতন এবং সমাজপ্রগতির প্রতি তাদের থাকতে হবে তীব্র আগ্রহ। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার পুরনো দ্বন্দ্বে পুনরায় মুখর হয়েছে রাজনীতির অসহিষ্ণুতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের অপছায়া পুনরায় রাজনীতিকে কলুষিত করতে চাচ্ছে। গল্পকাররা এসব বিষয়ে মনোযোগী হলে তাদের রচনার ক্যানভাসে ফুটে উঠতে পারে রাজনীতির চেতনা আর সমাজপ্রগতির রূপায়ণ। আবুল মনসুর আহমদ, শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সোমেন চন্দ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, রাহাত খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শওকত আলীসহ অনেকেই বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের গল্পকার হিসেবে আদর্শস্থানীয় হতে পারেন। নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন সভ্যতায় প্রবেশ করেছে। তারা ব্লগে লেখে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অংশগ্রহণ করে, মোবাইল সংযোগে সম্পর্কের বিস্তার ঘটায়। তাদের হাতে গল্প হয়ে উঠতে পারে নতুন বৈশ্বিক সামাজিক বিন্যাসের বাস্তবতায়। নতুন বৈশ্বিক-সামাজিক সম্পর্কের পরিসরে তারা উপলব্ধি করছে সমাজ ও রাজনীতির প্রবাহ। তারা বিশ্বায়ন ব্যবস্থা ও উত্তরাধুনিক কালের প্রবাহে এসে পরিপার্শ্ব ও মানবসম্পর্কের নতুন রূপ ও প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করতে পারছে। ছোটগল্পের মৃত্যু অত্যাসন্ন কি না তা নিয়েও পাঠকমনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। ইলেকট্রনিক সাহিত্য পরিসরে প্রবেশের ফলে কাগুজে সাহিত্য আর বইয়ের আকারে প্রকাশিত সাহিত্যের আবেদন কতটা টেকসই হবে তা নিয়েও জিজ্ঞাসার শেষ নেই। মানুষ, মানবজীবন, মানবসম্পর্ক যতদিন থাকবে সাহিত্য পরিসর এবং পাঠকদের আগ্রহের বহুমাত্রিক রূপও ততদিন থাকবে এটুকু বলা যায়। গল্পের আঙ্গিক, ধরন, কাঠামোগত রূপ ও বিষয়বস্তু পাল্টে যাচ্ছে। ইরাক, আফগানিান, ইসরাইল আর পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসপ্রবণতার দিকে তাকালে গল্পকারদের গল্পও ম্লান হয়ে যায়। সায়েন্স ফিকশনের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ বেড়েছে। ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হওয়ার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কার ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্য মানুষের জীবনকে ক্রমাগত অগ্রসর করছে, প্রভাবিত করছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে মানুষ আজ গল্পের নায়ক হয়ে উঠেছে নিজেই। বিস্ময়কর সব ঘটনা ঘটছে বিশ্বে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ডিজিটাল লাইফ এগিয়ে চলেছে। ন্যানো টেকনোলজির যুগে এসে মানুষ লক্ষ করছে পদার্থের পঞ্চম অবস্থা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, চতুর্থ জি মোবাইল, ইলেকট্রনিক সভ্যতার জয়যাত্রা। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে যন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে এগিয়ে চলতে। ডিজিটাল গ্রন্থাগার আর কাগজবিহীন সভ্যতার যুগে এসে তৈরি হচ্ছে নতুন গল্প। গল্পেও থাকে গল্প, ইতিহাসেরও থাকে ইতিহাস। বিদ্যমান সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি আর পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনের পরিসরে তবু থাকবে গল্প। সব গল্পের থাকে অবলম্বন। নতুন ও তরুণ প্রজন্ম উপহার দেবে বিস্ময়কর কিছু, ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমকালীন রাজনীতি ও পরিবর্তনশীল সমাজের চেতনা তরুণদের বিশেষত নতুন গল্পকারদের মধ্যে অধিক সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। নইলে তারা রাজনীতিসচেতন ও সমাজচেতনা সমৃদ্ধ গল্প লিখতে পারবে না। তারা সমাজ ও রাজনীতির ঐতিহ্য পাঠ করবেন, বর্তমানকে ধারণ করবেন চেতনা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করবেন। তাদের পাঠ, পর্যবেক্ষণ আর উপলব্ধির সমন্বয়ে যে গল্প আমরা পাবো আশা করি তাতে নতুনত্বের ছোঁয়া থাকবে, জীবন রূপায়ণের, রূপান্তরপ্রবণ সমাজ ও রাজনীতির আলোকে ভিন্নতর কিছু উপস্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সব গল্পের শিল্পসাফল্য এক রকম ব্যাপার নয়। অভিজ্ঞতার রূপায়ণ, বিষয়বস্তু আর মানবিক বোধের উচ্চারণ, রাজনীতির বহুবর্ণিলতা তাতে থাকবে। তরুণদের শিল্পচেতনা ও রূপশৈলী পর্যবেক্ষণ অধিক গ্রহণযোগ্য হলেই উত্তরণ ঘটবে। আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি ঘটবে গল্পের স্বতন্ত্রভুবনে বিস্তার ও বিকাশে। এ ক্ষেত্রে ক্রমাগত অন্বেষণ, অর্জন, ধারণ, রূপায়ণের আশ্রয়েই এগোতে হবে। পাঠকপ্রিয় গল্পের পরিসর স্বল্পমাত্রিক নাকি সুদীর্ঘ তার কোনো সুনির্দিষ্ট মানদ- বা ধরাবাঁধা আদর্শ নেই। বিশ্বসাহিত্যের পর্যবেক্ষণ, নিজের পরিপার্শ্ব আর সমাজ ও রাজনীতির ভিত্তিভূমি এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রবহমানতা গল্পকারদের অধিক প্রভাবিত করতে পারে।

রতনতনু ঘোষ
(অন্যধারায় প্রকাশিত)

বইঘর ইতিকাহিনী


এই শহরে একজন শফি সাহেব থাকতেন। সুন্দর একজন মানুষ। সর্ব অর্থে সুন্দর। গুণে, আচরণে, অবয়বে, কর্মে সুন্দর একজন মানুষ। নিরহংকারী, অমায়িক, স্বল্পবাক; যেন ফলভরা ছায়াঘেরা এক বিশাল বৃক্ষ। নিভৃতে এক কোণে দাঁড়িয়ে মৃদুমন্দ দোলা দিয়ে যাচ্ছেন শাখায়, পল্লবে, পাতায়। 
 
এই শহরে এখন আর শফি সাহেব নেই। সুন্দর মানুষটি বিদায় নিয়েছেন অনেকটা চুপিসারে। এ শহর থেকে দূরের আরেকটি শহরের হাসপাতালে। সে শহরের লোকেরা তাঁকে তেমন চেনে না। চিনলে খবরটি প্রথম পাতায় ছাপতো সে শহরের পত্রিকাগুলো। ৪ কিংবা ১৫-এর পৃষ্ঠায় নয়। চ্যানেলগুলো ফলাও করে বলতো। টকশো হতো।
এ শহর, যেটি ছিল তাঁর নিজের শহর, সে শহরেও এখন তাঁকে ক’জনে চেনেন? আমি আমার বয়েসি অনেককে (যাঁরা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি করেন) তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে একটু অবাক হয়েছি তারা তাঁকে চেনেন না জেনে। আমার পরবর্তী প্রজন্মের বেশিরভাগই তাঁকে চেনেন না। নামও শোনেন নি।
তবে দুঃখ করার কিছু আর নেই মনে হয়। চটজলদির এ যুগে সবকিছু তাৎক্ষণিক পাওয়ার বাসনায় ইঁদুর দৌড়ে অহর্নিশি ব্যস্ত। খাওয়া থেকে শুরু করে ক্যারিয়ারের চরম শিখরে পৌঁছা সবকিছুতে চটজলদি। পরিশ্রম, মেধা ব্যয়, ধৈর্য ধারণ অত সময় কোথায় কার হাতে আছে? ‘ধর তক্তা মার পেরেক’- এর এই যুগে অল্পতেই সবাই সবকিছু পেয়ে যায়। তরুণ বয়সেই যার যার ক্ষেত্রে সে সে নক্ষত্র। তাদের হাতে সবকিছু তুলে দেবার জন্য কিংবা তাদেরকে নক্ষত্র বানানোর জন্যেও দলে দলে অনেকেই প্রস্তুতি নিয়ে প্রতীক্ষায়।
সালাহউদ্দিন লাভলু সাম্প্রতিক এক লেখাতে বলেছেন, ‘আগে ছিল ঈদের নাটক। এখন নাটকের ঈদ’। সত্যিই তো আগে কেবল বিটিভিতে দুই ঈদে দুটি নাটক হতো। থাকতো দীর্ঘ প্রস্তুতি ও প্রতীক্ষা। দেখতো সবাই। আর এখন এক ঈদেই ডজন ডজন চ্যানেলে শত শত নাটক। কোনো প্রস্তুতিও নেই প্রতীক্ষাও নেই। কেউ দেখে না কোনো একটি সম্পূর্ণ নাটক। কোনো একজন দর্শকের হাতে অত সময় নেই এক নাগাড়ে দশ মিনিট একটি টিভি চ্যানেল দেখার। কী দেখবে? কেনইবা দেখবে। চরম হাস্যকর উদ্ভট উপস্থাপনা বিভিন্ন নামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। কারা এসব বানায়, কেন বানায় কে জানে! ভুল বললাম, জানে বিজ্ঞাপনদাতা এবং বিজ্ঞাপন প্রচারকেরা। কারণ বিজ্ঞাপন দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে কিছুতো দেখাতে হবে! এ যুগ মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ। শোবিজের যুগ। আটপৌরে বাংলায় ‘দেখানোপনার যুগ’।
কাজেই এ-যুগে শফি সাহেবদের মতো মানসম্পন্ন রুচিসম্পন্ন, সজ্জন, সংস্কৃতিসেবী মানুষদের কোনো দাম নেই কোনো স্থান নেই কোনো পরিচয় নেই। তাঁর পরিচিতি তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার শ্বশুর। সর্বত্র এই পরিচিতি। সে পরিচিতিতে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দেখতে যান। তাঁর জানাযা হয় ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে এবং দাফনও হয় বনানীর কবরস্থানে।
ভাবনা ছিল, চট্টগ্রামে তাঁর নশ্বরদেহটি হয়তো আনা হবে, এখানে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে হয়তো রাখা হবে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে, অনেক গুণগ্রাহী তাঁর এখনো এ শহরে আছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও পেতে পারতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এই নিরুচ্চার মানুষটির গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর ছাপাখানা আর্ট প্রেস থেকে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লিফলেট ছেপে দেশে বিদেশে প্রচার করতেন গোপনে। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে আশ্রয় দিয়ে অর্থ সাহায্য করে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় তাঁর প্রকাশিত এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত শিশু পত্রিকা টাপুর টুপুর এর সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের আসন্ন মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতাকে স্বাগত জানিয়ে লেখা হয়েছিল ‘রক্তাক্ত পথ ধরে আসবে স্বাধীনতা’। অসীম সাহস না থাকলে সে সময় এ ধরনের কথা লেখা যায় না। এ সাহস ছিল শফি সাহেবের অন্তরে। আচরণে তা প্রকাশ পেত না এই সদাহাস্য, নিরহংকারী নিভৃতচারী ও অভিজাত মানুষটির। ’৬৯ ও ’৭০ এর গণআন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি চট্টগ্রামে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি মহলও যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়, তখন নেপথ্য থেকে সোচ্চার ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ শফি।
শফি সাহেবের প্রধান পরিচয়- প্রকাশক। ফিরিঙ্গি বাজারে ছিল তাঁর কিংবদন্তী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘দি আর্ট প্রেস’, যেটি কেবল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে নয় ভারতেও যথেষ্ট সমাদৃত ছিল। দুই বাংলার প্রথিতযশা লেখকদের লেখা গ্রন্থ এই ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হতো। কাজ করতেন আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, বিপ্রদাস বড়ণ্ডয়া, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, সবিহ্‌উল আলম, কাইয়ুম চৌধুরী, হরিপ্রসন্ন পালসহ আরো অনেক গুণী শিল্পী সাহিত্যিক। কেউ পূর্ণ সময়ে, কেউ অতিথি হয়ে। এ-প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় পাকিস্তানের প্রথম রম্য মাসিক পত্রিকা ‘অন্তরঙ্গ’। সুচরিত চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হকের সম্পাদনায়। তবে আর্ট প্রেস বা সৈয়দ মোহাম্মদ শফীর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা শিশু পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’ যেটি প্রকাশিত হতো শিশু সাহিত্য বিতান থেকে। সম্পাদনা করতেন গুণী শিশু সাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমেদ যিনি ছিলেন শফী সাহেবের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। এখলাস সাহেবও ছিলেন ঠিক শফি সাহেবের মতোই আরেকজন নিভৃতচারী, অমায়িক এক নিপাট ভদ্র ও বিদ্দজ্জন মানুষ। শফি সাহেবের বাসায় ও আর্ট প্রেসে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সান্নিধ্যে আসারও। এদেশের শিশু সাহিত্যে তাঁর অপরিসীম অবদান।
বাংলা সাহিত্যের (দুই বঙ্গের) অনেক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থরাজি মুদ্রিত হয়েছে সৈয়দ মোহাম্মদ শফির প্রকাশনা সংস্থা ‘বইঘর’ থেকে। ‘বইঘর’ আরেকটি কিংবদন্তী। বইগুলোর প্রচ্ছদ অংকন অঙ্গসজ্জায় কাজ করেছেন জয়নুল আবেদীন, কাইয়ুম চৌধুরী, আবুল বারাক আলভী, রফিকুন্নবী, সবিহ্‌উল আলম, আবুল মনসুরসহ প্রথিতযশা অনেক শিল্পী। বইঘরের প্রকাশিত বইগুলো এতটাই দৃষ্টি নান্দনিক হতো, হাতে নেবার সাথে সাথে শ্রদ্ধা আর মমতা যেন একীভূত হত অন্তরে। মুদ্রণ পারিপাট্য, রুচিশীল ও ছিমছাম অঙ্গসৌষ্টব, অত্যন্ত উন্নতমানের বাঁধাই একেকটি বইকে পাঠকদের কাছে পরম আদরনীয় করে তুলতো। এত পরিশীলিত মুদ্রণ পরিপাট্য সে সময়ে তো বটেই, আজকের যুগেও অনেক দুর্লভ। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে বাংলাদেশে বইঘরের মতো আর কোনো প্রকাশনা সংস্থা গড়ে ওঠেনি। পশ্চিমবঙ্গের বাণীশিল্প, থীমা, অবভাস কিংবা প্রতিক্ষণ প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশনাগুলোই বোধকরি বইঘরের প্রকাশনার কাছাকাছি আসে। কেবল পরিচ্ছন্ন ও রুচিস্নিগ্ধ প্রকাশনা নয়, গ্রন্থের বিষয় নির্বাচনে যে বৈচিত্র্য, মান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন সেসব গুণাবলী বইঘর ও শফী সাহেবের যেন সহজাত ছিল।
মনে পড়ে, নিউমার্কেটের দোতলায় বইঘরের বিশালায়তনের সেই বিপনীকেন্দ্রের স্মৃতি। কোলাহলহীন পরিবেশে অজস্র গ্রন্থের সমাহার, যেন বই এর একটি রাজ্য। বিপনীকেন্দ্রের কর্মীরাও ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন ও সহযোগী মনোভাবাপন্ন। কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে নিয়মিতভাবে বইকেনার সামর্থ্য ছিল না, কিন্তু প্রায়ই যেতাম বইঘরে। কর্মীরা এ-বই সে-বই এগিয়ে দিতেন, বই সম্বন্ধে বলতেন, কিনতে পারছিনা দেখে মনক্ষুন্ন হতেন না, হয়তো তাঁরা বুঝতেন কিনতে আসিনি কিংবা কিনতে পারবো না, কিন্তু বই এর চাহিদা ও আগ্রহটুকু চাগিয়ে দিতেন মনে। কে জানে প্রকাশনা ও দোকানের মালিকের কোনো প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা ছিল কিনা এর নেপথ্যে। আর্ট প্রেসের মতো, বইঘর ও শিশুসাহিত্য বিতান এই দুই প্রকাশনা সংস্থার মতো, ‘বইঘর’ নামের বিশাল বইয়ের দোকানটিও ছিল কিংবদন্তীসম। চট্টগ্রামের অহংকার, সারা দেশও সে সব প্রতিষ্ঠানের কথা জানতো।
দি আর্ট প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। এটি ছিল সেসময় এদেশের বৃহৎ মুদ্রণশিল্প প্রতিষ্ঠান। আর্ট প্রেস কেবল একটি প্রিন্টিং হাউস ছিল না, ছিল এ শহরের, এদেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির এক মিলনকেন্দ্র।
মুদ্রণশিল্পে এদেশের পথিকৃৎ সৈয়দ মোহাম্মদ শফি চট্টগ্রামের শিল্পসংস্কৃতি জগতের একজন নিভৃতচারী সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এ শহরের প্রতিটি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তাঁর নেপথ্য অংশগ্রহণ থাকতো। চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। ১৯৮০ ও ৯০ এর দশকে চলচ্চিত্র সংসদ সংক্রান্ত অনেক মুদ্রণ সামগ্রী তিনি তাঁর প্রেস থেকে কখনো নামমাত্র দামে, কখনো বিনে পয়সায় ছেপে দিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের সদস্য ছিলেন। নিয়মিত চাঁদা দিতেন। প্রদর্শনীতে অনুপস্থিতির বিষয়ে অনুযোগ করলে স্মিতহাস্যে বলতেন, ‘লিস্ট থেকে নাম কেটে দিও না’। সে সময়ে কলকাতা ও লন্ডন থেকে বেশ কজন চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসেছিলেন। চট্টগ্রামে যখন তাঁদের আমরা আমন্ত্রণ জানাতাম, শফি সাহেবের বাড়ি ছিল তাঁদের সকলের থাকবার জায়গা। কোনোদিন তাঁকে দু’বার বলতে হয়নি। শুধু বলতেন, ‘ওনাদের পছন্দ অপছন্দ জেনে আমাদের জানিয়ে দিও’। আমাদের মানে তাঁর পরিবার। তাঁর স্ত্রীও তাঁরই মতো আরেকজন সহৃদয়া মানুষ। তাঁদের একমাত্র পুত্রও পিতা মাতার অবিকল প্রতিরূপ। অত্যন্ত সুদর্শন ‘বনি’ ছিল আমাদের সমবয়সী এবং বন্ধুসম। অনেক সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে তাদের বাসার অতিথিদের স্টেশনে, বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে আসতো সাগ্রহে। একই অভিজ্ঞতা অন্যান্য মাধ্যমের সংস্কৃতিকর্মীদের বেলাতেও আছে অবশ্যই।
চট্টগ্রামের চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে শফি সাহেবের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সভাটিও হয় আর্ট প্রেসে ১৯৭২ সালে।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে শফি সাহেবদের ব্যবসা মন্দাভাব হতে শুরু করে যার নেপথ্যের প্রধান কারণ এদেশের শিল্প সাহিত্যের জগতের অধোগতি ও ধস। মানহীন, সস্তা বাজারি মুদ্রণ ও সাহিত্য সৃষ্টি কোনোটার সাথেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি সৈয়দ মোহাম্মদ শফির পরিবার। একে একে বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশনা সংস্থা দুটি, গ্রন্থবিপনীকেন্দ্র বইঘর এবং প্রকাশনা সংস্থা দি আর্ট প্রেস। তিনিও ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চলে যান আরো নেপথ্যে। আর আমরা স্বার্থপরেরা তাঁর আর কোনো খোঁজখবরও রাখিনি, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায়।
কিন্তু প্রিন্টিং টেকনোলজির উৎকর্ষ সাধন ও তার বাস্তবায়নে শফি সাহেবের নাম অলক্ষে মিশে থাকবে। অনুসন্ধানী পাঠক, প্রকাশক, লেখক ঠিকই তাঁকে স্মরণে রাখবেন। সৈয়দ মোহাম্মদ শফি বাংলাদেশে শিশুসাহিত্য প্রকাশনার ওপর ইউনেস্কো থেকে প্রথম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি। শিশুসাহিত্য, সামাজিক কর্মকান্ড ও প্রকাশনায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮১ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে ‘শ্রেষ্ঠ প্রকাশক’-এর স্বর্ণপদক পান তিনি। ইউনেস্কো তাঁকে ‘বেস্ট পাবলিসার’- এর সম্মাননা দেয়। লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল ১৯৮৪ সালে তাঁকে প্রথম এশিয়ান নাগরিক হিসেবে ‘কি অব স্টেট’ পদক প্রদান করে। রাষ্ট্রীয় কিছু শীর্ষ পদক আছে আমাদের। কত জনা পায়। কিন্তু এসব গুণী মানুষেরা বঞ্চিত থাকেন বরাবর।
সৈয়দ মোহাম্মদ শফির জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হলেও অত্যন্ত কষ্ট করে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছিল। পরিশীলিত রুচিবোধে সমৃদ্ধ মানুষটির শুচিস্নিগ্ধতা তাঁর ব্যক্তি জীবনে সবসময় বিরাজিত থাকতো। তাঁর অফিস, প্রেস, দোকানের মতো তাঁর বাড়িটিও ছিল অত্যন্ত পরিপাটি। বাহুল্য বর্জিত কিন্তু অত্যন্ত অভিজাত। পূর্ণেন্দ্র পত্রী ও চিত্তানন্দ দাশগুপ্ত (সস্ত্রীক)কে চট্টগ্রামে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনার পর তাঁদের বাড়িতে আমরা রেখেছিলাম যথারীতি। এঁরা শফি সাহেবের আতিথ্যের ও আভিজাত্যের এতটাই গুণমুগ্ধ হয়েছিলেন যে, পরবর্তী সময়ে তাঁদের বিভিন্ন লেখায় তার সপ্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন।
 
শফি সাহেব যখন মুদ্রণ শিল্পে কাজ করেছেন তখন এখনকার মতো এত সুযোগ সুবিধা ছিল না। লেটারপ্রেসেও ছিল তাঁর অধিকাংশ কাজ। শেষের দিকে অফসেট প্রকাশনা করলেও এত সুযোগ তখনো হয়নি। অথচ স্রেফ মেধা ও আন্তরিকতার জোরে তিনি সেসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে উন্নত প্রকাশনায় পথিকৃৎ হতে পেরেছিলেন। যাঁর সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর সততা, পরিশ্রম ও নিরহংকার। অন্য কাউকে অনুসরণের সুযোগ তিনি পাননি। নিজেই তৈরি করেছিলেন তিনি নিজেকে আমরাই যেন অনুকরণ করি তাঁকে। তাঁর উত্তরাধিকার ধারণ করি কর্মে আর আচরণে। আজ যখন চট্টগ্রামের ‘বাতিঘর’ ঢাকার ‘পাঠক সমাবেশ’ দেখি তখন বই ঘরের সেই ফেলে আসা স্মৃতি যেন দু’চোখ ভরে ভেসে ওঠে। মনে হয় বইঘর হারিয়ে যায়নি। যাবে না কোনোদিন। ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর শফি সাহেবও হারিয়ে যাননি। থেমে যায়নি তাঁর পথ চলা। নতুন উত্তরাধিকারির মধ্যে তাঁর পুনজ্জীবন ঘটবে। জীবন যে নিরন্তর।
 
সুত্র:  শৈবাল চৌধুরী (দৈনিক আজাদী)